
‘যুগান্তর’
শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৭, ২৬ কার্তিক ১৪২৪
আমি এখানে ছিলাম।
পরে, মাটিতে পায়ের ছাপ রেখে হেঁটে যাই
দূর পাহাড়পুর।
তাল-তাল কাদা মাটি দিয়ে
মাটির পুতুলে গড়ি নিজেরই প্রতিবিম্ব।
হরপ্পার চাকা। মহীবুল আজিজ
‘সেই প্রথম দিন দেখেই আমি ভেতরে ভেতরে মুগ্ধ হয়েছিলাম। কারণ তার চোখের দৃষ্টিটা ছিল উজ্জ্বল।’ অনুজ মহীবুল আজিজকে নিয়ে এভাবেই শুরু করেছেন অগ্রজ হাসান আজিজুল হক তার স্মৃতিকথা। মহীবুল আজিজ। বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী লেখকদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় বিস্তৃত কর্মপরিধির মাঝখানে দাঁড়ানো এক ব্যতিক্রমী লেখক সত্তা। জীবনের ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে আজকের যে মহীবুল আজিজকে আমরা চিনি, তিনি আসলে কী? কবি? গল্পকার? ঔপন্যাসিক? প্রাবন্ধিক? গবেষক? অনুবাদক? হ্যাঁ, তৃতীয় চোখের এই ৬৮৮ পৃষ্ঠাই যেন যথেষ্ট নয় একজন পূর্ণাঙ্গ মহীবুল আজিজকে উপস্থাপন করতে।
কবি ময়ুখ চৌধুরীর ভাষায়- ‘নাটক আর মহাকাব্যকেই তিনি রেহাই দিয়েছেন; এ ছাড়া সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে তিনি হাত বাড়াননি।’ আলী প্রয়াস সম্পাদিত ‘তৃতীয় চোখ’ একজন বহুমুখী মহীবুল আজিজকে পাঠকের সামনে উপস্থাপনের জন্য যে শ্রম দিয়েছে, তার প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা রেখেই শুরু হোক ‘মহীবুল আজিজ সংখ্যা’র মুগ্ধপাঠ। সংখ্যার মূল আয়োজন শুরু হয়েছে মহীবুল আজিজকে লেখা বিশিষ্টজনদের ২৬টি চিঠি দিয়ে। চিঠিগুলো যেন স্পষ্ট জানান দিচ্ছে তার নানা রঙের যাত্রাপথ। সাক্ষাৎকার দুটি এ সংখ্যার অনন্য সংযোজন। পড়ছিলাম আর বারবার মনে হচ্ছিল খালেদ হামিদী এবং আলী প্রয়াসের সঙ্গে আমিও ঢুকে পড়েছি মহীবুল আজিজের গল্পের বারান্দায়।
‘ব্যক্তি ও লেখা মূল্যায়ন’ বিভাগে মহীবুল আজিজকে নিয়ে অগ্রজ-অনুজদের স্মৃতিচারণমূলক মূল্যায়নগুলো বেশ মজার। রেশ রেখে গেল হাসান আজিজুল হক, অনুপম সেন, ময়ুখ চৌধুরী, সেলিনা শেলী ও শাকিল আহমেদের লেখা। সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শাখা ছোটগল্পে মহীবুল আজিজ এক ভিন্ন স্বর। তার ছোটগল্পের নানা দিক বিশ্লেষণ নিয়ে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখা। সৈয়দ আকরম হোসেন, সুশান্ত মজুমদার, প্রশান্ত মৃধা, দেবাশিস ভট্টাচার্য, ইমতিয়ার শামীম, মহি মুহাম্মদ, চন্দন আনোয়ার, শীলাবৃষ্টি এবং মোহছেনা ঝর্ণার লেখার গদ্যময়তা সাবলীল করে তুলেছে বিভাগটিকে।
১৯৬২ সালে মহীবুল আজিজের জন্ম। ১৯৭১-এ ৯ বছরের বালকের চোখে দেখা মুক্তিযুদ্ধকে তিনি গল্পে হাজির করেছেন ভিন্ন বাস্তবতায়, ভিন্ন এক রূপকল্পে। গল্প সংকলন ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ নিয়ে আলোচনা করেছেন শিরীণ আখতার, মনি হায়দার ও বিদ্যুৎ দেব। এ পর্যন্ত প্রকাশিত চৌদ্দটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে কাব্য মূল্যায়নগুলো পাঠকের কাব্যতৃষ্ণা বাড়িয়ে তুলবে। ভালো লেগেছে মনিরুজ্জামান, মাহবুবুল হক, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ভাগ্যধন বড়–য়া, মানিক বৈরাগী, আহমেদ রাসেল, হাসনাইন হীরা ও সানাউল্লাহ সাগরের লেখা। মহীবুল আজিজ উপন্যাস লিখেছেন দুটি। মুক্তিযুদ্ধনির্ভর উপন্যাস দুটি নিয়ে বিকাশ মজুমদার, সালেহা নার্গিস ও নাজমুন নাহারের মূল্যায়নগুলো মুগ্ধতা রেখে যাবে। রয়েছে আটটি প্রবন্ধগ্রন্থ নিয়ে বেশ কিছু লেখা এবং মহীবুল আজিজের তিনটি গবেষণাগ্রন্থ নিয়ে বেশ কিছু মূল্যায়ন। মহীবুল আজিজের অনুবাদ নিয়ে আছে দুটি লেখা।
সংখ্যাটির গুরুত্বপূর্ণ একটি বিভাগ ‘বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক’। বন্ধু মহীবুল আজিজকে নিয়ে গল্পকার মামুন হোসাইন তার লেখাটি শেষ করতে গিয়ে লিখেছেন- ‘বহুকাল পর, আগামী সৃষ্টির সম্ভাবনাময় সময় খুঁজতে গিয়ে মানুষ তখন জানবে মহীবুল ছিলেন আমাদের অন্যতম প্রধান সহভাষী, সমহৃদয়ী ও গাঢ়তম সখা।’ মহীবুল আজিজ সম্পাদিত ‘লিটল ম্যাগাজিন’ নিয়ে সৈকত দে’র লেখাটিতে একজন সম্পাদক মহীবুল আজিজকে পাঠক চিনবে সহজেই। সংখ্যাটিতে স্থান পেয়েছে তার নির্বাচিত দশটি কবিতা, শ্রেষ্ঠ তিনটি গল্প এবং দুটি প্রবন্ধ। সবগুলো লেখাই সুনির্বাচিত। ছবির অ্যালবাম ‘স্মৃতির জানালা’য় যেন খেলা করতে করতে শৈশব থেকে বড় হয়ে উঠছেন লেখক। সংক্ষিপ্ত পরিচিতির সঙ্গে লেখকের আত্মজীবনীর খসড়াটি তাকে জানতে একটু বেশিই সহায়ক হবে।
সাহিত্যে সমর্পিত একজন সম্পূর্ণ সাহিত্যিক মহীবুল আজিজকে নতুন করে চিনিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে ‘তৃতীয় চোখ’। তবে তার স্বজনদের কিছু লেখা হয়তো ব্যক্তি মহীবুলকে চেনাতে আরও বেশি সক্ষম হতো। বরাবরের মতো এ সংখ্যাটিও তার আঙ্গিক সৌন্দর্য বজায় রেখেই শেষ হয়েছে। এক চিঠিতে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস লিখেছেন- ‘প্রিয় মহীবুল আজিজ, অনেকদিন তোমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।’ সংখ্যাটির পাঠ যখন শেষ করছিলাম; ভাবছিলাম আজ যদি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেঁচে থাকতেন; তিনি হয়তো লিখতেন তাদের অনেক একত্রবাস আর আড্ডার গল্প।